২৫ বছর আগে যে স্বপ্নের বীজ বোনা হয়েছিল, সেই স্বপ্ন এখন বাস্তব। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে নির্মিত পদ্মাসেতু এখন উদ্বোধনের অপেক্ষায়। ২৫ জুন পদ্মাসেতু উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। স্বপ্নের পদ্মাসেতু বাস্তবায়ন ও দৃশ্যমান হওয়ার পর থেকেই দেশ-বিদেশে প্রশংসিত হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সম্প্রতি পাকিস্তানের পাঞ্জাবের শিক্ষাবিদ, গবেষক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক ড. মালিকা-ই-আবিদা খাত্তাক পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম ডেইলি টাইমসে ‘বাংলাদেশের পদ্মা সেতুর গল্প: স্রেফ একটা সেতুর চেয়ে বড় কিছু?’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেছেন।
পাঠকদের উদ্দেশ্যে সেই নিবন্ধের অনুবাদ তুলে ধরা হলো-
বাংলাদেশের বহুল প্রত্যাশিত পদ্মা সেতু একটি স্বপ্নের প্রকল্পও। আগামী ২৫ জুন এটি উদ্বোধন হতে যাচ্ছে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদ সকাল ১০টায় দীর্ঘ প্রতীক্ষিত সেতুটি উদ্বোধন করবেন।
দেশটির দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার যাত্রীরা বাংলাবাজার-শিমুলিয়া রুটে ফেরি দিয়ে পদ্মা নদী পার হয়। দীর্ঘ যানজটে ভোগান্তিতে পড়তে হয় যাত্রী ও চালকদের। চালু হলে এটি হবে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ সেতু এবং সড়ক চলাচলের জন্য প্রথম নির্দিষ্ট নদী পারাপার। দ্বি-স্তরের ইস্পাত ট্রাস সেতুটি উপরের স্তরে একটি চার লেনের মহাসড়ক এবং নিচের স্তরে একটি একক-ট্র্যাক রেলপথ বহন করবে।
দক্ষিণাঞ্চলের লাখো মানুষের স্বপ্নের পদ্মা সেতু আগামী মাসে উদ্বোধন হতে যাচ্ছে। এর ফলে মানুষের দুর্ভোগের অবসান ঘটবে। এই বহুমুখী সেতু বাংলাদেশের একটি স্বপ্নের প্রকল্প। মুন্সীগঞ্জের মাওয়া পয়েন্ট এবং শরীয়তপুরের জাজিরা পয়েন্টকে সংযুক্ত করবে এটি; যা যাত্রী ও মালবাহী যানবাহনের জন্য যাত্রা সহজ করবে এবং ক্রমান্বয়ে দেশের জিডিপি ১ দশমিক ৩ থেকে ২ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করবে।
পদ্মা সেতু নকশা করা হয়েছে দ্বি-স্তর বিশিষ্ট স্টিল-ট্রাস কম্পোজিট কিপিং রোডের ওপর এবং নিচে রেলপথটি বিশ্বের গভীরতম ভিত্তি সেতু। ২৫ জুন পূর্ব পাশে সেতুর উদ্বোধনের পর নদীর অপর প্রান্তে বিশাল জনসভায় ভাষণ দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর এটিই হবে ২০১৮ সালের পর দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে জনসাধারণের সামনে তার প্রথম উপস্থিতি।
বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রতীক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদ পদ্মা সেতুর মতো বিশ্বে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে আত্মবিশ্বাস ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। বিশাল প্রতিবন্ধকতার পথে হাঁটতে হলেও গন্তব্যে ঠিকই পৌঁছেছেন তিনি। সেতুটি নির্মাণের সময় যে ষড়যন্ত্র ছড়িয়েছিল তা দৃঢ়তার সাথে মোকাবিলা করে সত্য প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি।
শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বের স্বাক্ষর বহন করে পদ্মা সেতু। শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশের সক্ষমতা আরও একবার জানার সুযোগ পেল বিশ্ব। বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যারা বারবার তাদের সক্ষমতা দেখিয়েছে।
পদ্মা সেতুর কাজ প্রায় শেষের দিকে। বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগে প্রতিশ্রুতি প্রত্যাহার করে এবং অন্যান্য দাতারা তা অনুসরণ করে। সেতুর ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়ে এবং পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। বিশ্বব্যাংক ও দাতারা মুখ ফিরিয়ে নেয়। তখন সমালোচকরা হাসিতে ফেটে পড়েন। শেখ হাসিনার পক্ষে পদ্মা সেতু করা সম্ভব হবে না বলে বিরূপ মন্তব্যের ঝড় তোলেন তারা।
বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগ এনে এক ব্যক্তির যোগসাজশে বোর্ড সভা না করে সেতু নির্মাণে অর্থায়ন বন্ধ করে দেয়। যা পরবর্তীতে ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয়। পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির কোনো প্রমাণ পায়নি কানাডার আদালত। তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করতে হয়। এটি ছিল পদ্মা সেতু নির্মাণের শুরুর চিত্র। কিন্তু নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ার পর আসে বড় চ্যালেঞ্জ। নদী শাসন ও পাইলিংয়ের ক্ষেত্রে সাহসী এবং যুগান্তকারী প্রকৌশল দক্ষতা প্রয়োজন হয়। একই সময়ে বাড়তে থাকে নির্মাণ ব্যয়।
করোনার হানা শুরু হলেও পুরোদমে চলে সেতুর নির্মাণ কাজ। শেখ হাসিনার অদম্য ইচ্ছা শক্তির কারণে সেতুর কাজ একদিনের জন্যও বন্ধ হয়নি। করোনা মোকাবিলা করেই পদ্মা সেতুর কাজ এগিয়ে নেওয়া হয়েছে। সবাই যখন দেখল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সেতুর কাজ এগিয়ে যাচ্ছে, তখন কিছু অসাধু ও ষড়যন্ত্রকারী গুজব ছড়াতে থাকে।
সেতু তৈরিতে মানুষের মাথা লাগবে বলে গুজব ছড়ানো হয়। সরকার দক্ষতার সঙ্গে এ ধরনের গুজব মোকাবিলা করেছে।
শেখ হাসিনার অদম্য ইচ্ছা শক্তিতে শুধু পদ্মা সেতুই নয়, মেট্রোরেল ও দেশটির বৃহত্তম টানেলের কাজও প্রায় শেষের দিকে। সেগুলো চলতি বছর জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হবে। একই সঙ্গে অনেক মেগা প্রকল্পের কাজও চলছে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মাতারবাড়ি প্রকল্প, যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু রেল সেতু নির্মাণ, পায়রা সমুদ্র বন্দর নির্মাণ, বঙ্গবন্ধু শিল্প নগরী নির্মাণসহ অনেক প্রকল্প উল্লেখযোগ্য। তবে পদ্মা সেতু নির্মাণ ছিল সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং। পদ্মা সেতু শুধু একটি সেতু নয়; দেশটির একটি বড় সম্পদও। পদ্মা সেতু বাংলাদেশের পদ্মা নদীর উপর নির্মিত একটি বহুমুখী সড়ক ও রেলসেতু। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে উত্তর-পূর্ব অংশ সংযুক্ত হবে। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ১৮ দশমিক ১০ মিটার প্রশস্ত সেতুটির নির্মাণ কাজ ২০১৪ সালের ৭ ডিসেম্বর শুরু হয়েছিল।
পদ্মা সেতু আজ দৃশ্যমান। গর্বের সেতু আজ দাঁড়িয়ে আছে। নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে সারা বিশ্বে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর একটি সাহসী সিদ্ধান্ত তাকে একজন আত্মবিশ্বাসী, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে বিশ্ব স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি, ক্রমাগত জিডিপি প্রবৃদ্ধি এবং বিভিন্ন সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের অবস্থানের উন্নতি আজ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। এই সেতুর জন্য প্রধানমন্ত্রী যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন, পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের সাফল্য সেই ত্যাগকে যৌক্তিক করে তুলেছে।
প্রাথমিকভাবে নির্মাণ খরচ কম হলেও পরবর্তীতে কয়েক ধাপে বৃদ্ধি পেয়ে ৩.৮৬৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়ায়। নির্মাণের সময় ও ব্যয়— উভয়ই বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও নির্মাণ ব্যয় নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে। তারপরও সবচেয়ে আশার বিষয় হলো, সেতুটি সম্পূর্ণ হয়েছে এবং জনসাধারণের জন্য জুন মাসে খুলে দেওয়া হবে।
এই সেতুটি রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি এবং সামাজিক বিভিন্ন ঘটনার সাথে গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট। সেতুটির নির্মাণ বাংলাদেশের জন্য বড় রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ ছিল। সেতুটি চালু হলে দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা হবে, বদলে যাবে অর্থনীতির কাঠামো।
কৃষির ব্যাপক উন্নয়ন হবে। সেতুটি দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে রাজধানীতে কৃষিপণ্য পরিবহনে যুগান্তকারী এক অধ্যায় তৈরি করবে। কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্যের ভালো দাম পাবেন। পদ্মা সেতুকে ঘিরে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ব্যাপক শিল্পায়ন ঘটবে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের একটি অংশ হয়ে উঠতে পারে পদ্মা সেতু। যোগাযোগ ও পরিবহন ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটবে। এই সেতুর মাধ্যমে পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন হবে। সেতুটির মুন্সীগঞ্জ ও শরীয়তপুর অংশে একটি ছয় লেনের এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হয়েছে; যা অত্যন্ত নজরকাড়া ও চিত্তাকর্ষক।
সংস্কৃতিতে অনন্য ভূমিকা রাখবে এই সেতু। এই সেতুর চারপাশে গড়ে তোলা হবে রিসোর্ট, হোটেল ও রেস্তোরাঁ, যেখানে বাঙালি খাবার পরিবেশন করা হবে। যা বিদেশিদের কাছে বাঙালি সংস্কৃতিকে আরও পরিচিত করে তুলবে। পদ্মা সেতু দেশটির জিডিপি এবং মাথাপিছু আয় বাড়াবে।
এই সেতু দেশটির দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে রেল যোগাযোগ আরও মজবুত করবে। মানুষ ঢাকা থেকে স্বল্প সময়ে স্বাচ্ছন্দ্যে যাতায়াত করতে পারবে। সেতু ঘিরে গড়ে উঠবে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি পাবে বহুগুণ।
পদ্মা সেতুর নাম উচ্চারণ করা হলে শেখ হাসিনা ওয়াজেদের নামও উচ্চারণ করতে হবে। শেখ হাসিনা ও পদ্মা সেতু একে অপরের পরিপূরক। তাদের আলাদা করার সুযোগ নেই। পদ্মা সেতুর নাম শেখ হাসিনা ওয়াজেদের নামে না হলেও প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম জানবে শেখ হাসিনার জন্যই এই সেতু সম্ভব হয়েছে।
শেখ হাসিনা ওয়াজেদ পদ্মা সেতু নির্মাণের বিশাল চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছেন এবং জয়ী হয়েছেন। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছে। পদ্মা সেতু দেশটিকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাবে। বাংলাদেশকে উন্নত দেশের কাতারে নিয়ে যেতে এই সেতু অনন্য ভূমিকা রাখবে।
বহুল প্রতীক্ষিত পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত, যা আগামী ২৫ জুন যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত হতে চলেছে, বিশ্বে দেশটির ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে এবং জাতির আস্থাকে ত্বরান্বিত করেছে।